আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা যা কিনা প্রাচীন মসজিদের শহর হিসেবেও বিখ্যাত। সুলতানি আমলে ১৪৫০ থেকে ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল গৌড় যার বর্তমান নাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সেই সময় ঐতিহাসিক গৌড় রাজ্যের নবাবদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিখ্যাত মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন ও ইতিহাস। আজ আমরা একদিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘুরার পাশাপাশি বাংলার প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করবো।
বছরের যেকোনো সময়ই চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘুরতে যাওয়া যায় কিন্তু আমার মতে আমের সিজন বিশেষ করে মে মাস থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় হল চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘুরতে যাওয়ার উত্তম সময়, কেননা এই সময়ে আপনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘুরার পাশাপাশি চাঁপাই এর বিখ্যাত হিমসাগর, ল্যাংড়া সহ অন্যান্য জাতের আম খুব সস্তায় কিনতে পারবেন আর ফ্রিতে ভরপেট আম খাওয়া তো আছেই।
ঢাকার কল্যাণপুর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট/শিবগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন বাস ছাড়ে ভাড়া নন এসি ৫০০ টাকা, এসি ৮০০-১১০০ টাকা, আর ট্রেনে আসতে চাইলে কমলাপুর থেকে রাত ১১ টায় পদ্মা এক্সপ্রেসে করে আপনাকে রাজশাহী আসতে হবে ভাড়া ৩৪০ টাকা এবং রাজশাহী থেকে লোকাল বাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিশ্বরোড মোড় আসতে হবে, ভাড়া পড়বে ৫০ থেকে ৯০ টাকা।
সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌছে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে সারাদিনের জন্য একটি অটো রিজার্ভ করে নিলে ভালো হয়। রিজার্ভ ভাড়া পরবে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর ছেড়ে মহানন্দা সেতু পার হলেই মসৃণ পিচঢালা পথ চলে গেছে শিবগঞ্জ উপজেলায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সকল দর্শনীয় স্থানগুলি শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত হওয়ার কারণে এই পিচঢালা পথ ধরেই আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, পিচঢালা পথের দুপাশে চোখে পড়বে প্রচুর আমগাছ, এযেন রাস্তার দুপাশে আমগাছের অরণ্য আর গাছে গাছে থরে থরে ধরে আছে আম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের দর্শনীয় স্থান গুলির বর্ণনা যথাক্রমে নিচে দেয়া হল:
১. ছোট সোনা মসজিদ:
দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ শুরু করা যাক ছোট সোনা মসজিদ দিয়ে। ছোট সোনা মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। মসজিদের মাঝের দরজার উপর প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দীন শাহ এর শাসনামলে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে) ওয়ালি মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদটির বিশেষত্ব হলো এটি সম্পূর্ণ পাথর দিয়ে তৈরি। পুরাতন ২০ টাকার নোটে ছোট সোনা মসজিদের ছবি পাওয়া যায়। এই মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।
২. চামচিকা মসজিদ:
ছোট সোনা মসজিদ থেকে ১০ মিনিটের দূরত্বে শাহবাজপুরের একদম সীমান্তসংলগ্ন এক আমবাগানের ভেতর একটি নিচু স্থানে প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এই মসজিদের অবস্থান। ভারতের মালদা এলাকার বড় চামচিকা মসজিদের অনুকরণে তৈরি হওয়ার কারণে স্থানীয় ভাবে এই মসজিদটি চামচিকা মসজিদ নামেই পরিচিত। মসজিদটির দেয়ালে রয়েছে অসাধারণ কারুকাজ এবং মসজিদটির দেয়াল অনেক পুরু হওয়ায় চৈত্র মাসের গরমেও মসজিদের অভ্যন্তরে ঠান্ডা থাকে। মসজিদের পাশেই রয়েছে এক বিশাল দিঘী, যা খনিয়াদিঘি নামে পরিচিত। এই দীঘির কারণেই মসজিদকে অনেকে খনিয়াদীঘি মসজিদ নামেও চেনে। তাছাড়াও খঞ্জনদীঘি মসজিদ ও রাজবিবি মসজিদ নামেও চামচিকা মসজিদটির জনস্রুত পাওয়া যায়।
৩. তাহখানা (ত্ব-হা খানা) কমপ্লেক্স:
ছোট সোনা মসজিদ থেকে ৫০০ মিটার উত্তর-পশ্চিমে তাহখানা কমপ্লেক্স এর অবস্থান। ধারণা করা হয় সাধক হযরত শাহ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহ (রহ:) মোঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র মোঘল সুবেদার শাহ সুজার শাসনামলে দিল্লি থেকে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এখানে আসেন এবং শাহ সুজা তার নিকট বায়াত প্রাপ্ত হন। শাহ সুজা ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে তার শাইখ নেয়ামতউল্লাহ (রহ:) এরজন্য এই তাহখানা কমপ্লেক্সটি নির্মাণ করেন। তাহখানা কমপ্লেক্সটির পেছনেই রয়েছে “জাহেদুল বালা” নামের বিশাল দিঘী এবং এই দীঘির পাশেই রয়েছে তিন গম্বুজ মসজিদ এবং মাজার। এই তিনগম্বুজ মসজিদকে ঘিরে একটি মিথ প্রচলিত আছে, এর তিনটি পিলারের মধ্যে একটি পিলার জীবন্ত এবং তা একা একা বড় হচ্ছে।
৪. দারাসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা:
তাহখানা কমপ্লেক্স থেকে জিরো পয়েন্টের দিকে কিছুদূর এগুলেই হাতের বাঁপাশে দারাসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসার সাইনবোর্ড দেখা যায়। মূল সড়ক থেকে কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে কিছুদূর এগুলেই আম বাগানের ভেতর দৃষ্টিনন্দন দারাসবাড়ি মসজিদের দেখা পাওয়া যায়। দারাসবাড়ি মসজিদ বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্য কীর্তির একটি অন্যতম নিদর্শন। ধারণা করা হয়, সুলতান শামস উদ্দিন শাহের রাজত্বকালে ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে তারই নির্দেশে মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদটি দীর্ঘদিন মাটি চাপা পড়েছিল, সত্তর দশকের প্রথম ভাগে খনন করে এটিকে উদ্ধার করা হয়। মসজিদটির দরজা, জানালা এমনকি উপরের ছাদ ও নেই, শুধু মসজিদটির উঁচু দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে।
দারাসবাড়ি মসজিদ এর ১৫০ মিটার পূর্বদিকে আরেকটি আমবাগানে দৃষ্টিগোচর হয় দারাসবাড়ি মাদ্রাসার। ধারণা করা হয় ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাসাটি নির্মাণ করা হয় এবং এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন মাদরাসার নিদর্শন। বর্তমানে মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষই অবশিষ্ট আছে।
সবশেষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর সোনামসজিদ স্থলবন্দর ঘুরে কানসাট এসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে পারেন। খাবার শেষে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে এবার আমবাগানে ঘুরার পালা। পছন্দমতো যেকোনো একটি আমবাগানে ঢুকে পড়তে পারেন। বাগান মালিকের অনুমতি নিয়ে গাছ থেকে আম পেরেও খেতে পারেন। বাগানের নিচে পড়ে থাকা আমগুলোর জন্য কোন অনুমতির প্রয়োজন নেই। এটা ঐ এলাকার রীতি যে, পড়ে থাকা আম যে পাবে সেটাই তার। তাছাড়া কানসাটে পাইকারি আমের বাজার বসে। অনেক সস্তায় পাইকারি দরে আম কিনে আনতে পারেন। যদি হাতে সময় থাকে তাহলে মহানন্দা নদীর পাড়ে সন্ধ্যার কিছু সময় কাটাতে পারেন, সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে। আর ফেরার সময় অবশ্যই চাঁপাই শহরের কালাইয়ের রুটি খেয়ে আসতে ভুলবেন না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষগুলো খুবই উদার এবং সহজ-সরল মনের হয়ে থাকে। আমি নিশ্চিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ত্যাগ করার মুহূর্তেও সেই উদার মানুষগুলির দরদ মাখা কণ্ঠ আপনার কানে বাজবে।