সময়টা তখন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস, অফিসের কাজের চাপের পাশাপাশি বসের উপর অসম্ভব রকম বিরক্ত, হঠাৎ করেই চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ভ্যাগাবন্ড জীবনে পদার্পণ। টেনশনমুক্ত কিছু সময় উপভোগ করার জন্য প্ল্যান করি প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার। তাই তো প্রকৃতিকে অনুভব করার জন্য আমার প্রথম পছন্দ ছিল “সাজেক”, যা ছিল আমার জীবনের প্রথম একাকী ভ্রমণ / সলো ট্রাভেলিং।
কোনো ভ্রমণ শুরু করার পূর্বে আমি সবসময় ফেসবুক এর ট্রাভেল সম্পর্কিত গ্রুপগুলিতে ভ্রমণ জায়গা সম্পর্কে ঘাটা-ঘাটি করি। একই রকমভাবে সাজেকে আসা-যাওয়া, দর্শনীয় স্থান, খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কে কিছুটা আইডিয়া নেই এবং সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ আমার সলো সাজেক ভ্রমণ শুরু করি।
ব্যাগ গুছিয়ে রাত ৮টায় বাসা থেকে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড এর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। সত্যি কথা বলতে খুব ভয় লাগছিল, একা একা কিভাবে ঘুরবো!!! তারপরও আল্লাহর নামে বের হই এবং সায়েদাবাদ পৌঁছে রাত ১১টার শ্যামলী পরিবহনের খাগড়াছড়ি যাওয়ার টিকেট কাটি।
বাস যথাসময়ে ছাড়লো, আমার পাশের আসনে খাগড়াছড়ির এক লোকাল ছেলে বসে ছিল। সে জিজ্ঞেস করলো আমি কার সাথে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি? যখন শুনলো আমি একাই সাজেকে বেড়াতে যাচ্ছি, ছেলেটা খুবই অবাক হল, একা আবার ঘুরা যায় নাকি!!! ভাবলাম সারারাত বাসে ঘুমিয়ে কাটাবো কিন্তু ঘুম আসছিল না। মধ্যরাতে হঠাৎ বাসের ড্রাইভার হেড লাইট বন্ধ করে খুব স্পিডে ড্রাইভ করছিল এবং বাসের যাত্রীরা চিৎকার চেঁচামেচি করছিল, বাস আস্তে চালানোর জন্য। কিন্তু ড্রাইভার মামা তার মর্জি মতোই চালাচ্ছিল। আমি মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম বাসের হয়তো ব্রেক ফেল করেছে এবং আমি আজ শেষ। কিছুক্ষণ পর বাসের হেডলাইট জ্বালিয়ে বাস আবার যখন স্বাভাবিক গতিতে চলছিল তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। পরে জানতে পারি সেই রাস্তায় ডাকাতির ভয় ছিল, তাই ড্রাইভার ঐরকম রাফ-টাফ ভাবে ড্রাইভ করছিল।
অবশেষে ভোর ৫টায় খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছাই। বাস থেকে নেমেই পাশের এক হোটেলে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেই, সাথে সকালের নাস্তা ও সেরে ফেলি। বাসা থেকে বের হওয়ার আগের রাতে সাজেক যাওয়ার জিপ শেয়ারিং এর জন্য ফেসবুকে কয়েকজনের পোষ্ট দেখি। সেখান থেকে আমি দুইজনের মোবাইল নাম্বার সেভ করে রেখেছিলাম। নাস্তা শেষে সেভ করা নাম্বার থেকে আসাদ নামের একজনকে কল দেই। কিন্তু উনি বললো তার জিপ ফুল হয়ে গেছে। হতাশ হতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আসাদ ভাইই বলল আপনারা কতজন? আমি বললাম আমি একাই। তখন উনি বলল একা হলে তাদের সাথে যেতে পারবো। খুশি হয়ে গেলাম এবং সাথে সাথে আসাদ ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। একটি জিপে আমরা কয়েকটি গ্রুপের অনেকগুলো অপরিচিত লোক ছিলাম। চলতে চলতে সবাই সবার সাথে পরিচিত হলাম। আসাদ ভাইয়েরা ৪ বন্ধু, শাকিলরা ছিল ৩ বন্ধু, অভিরা ২ বন্ধু, সাঈদ ভাই তার ওয়াইফ ও শালা-শালি মিলে ৪জন এবং আমি ১জন। যাওয়ার সময় আমাদের সাথে যোগ দেয় ক্লিনটন ভাই যিনি খাগড়াছড়ির স্থানীয় বাসিন্দা। টোটাল আমরা ১৪ জন।
শুরুতেই আমরা গেলাম রিসাং ঝর্ণায়। রিসাং ঝর্ণায় যাওয়ার পথে জিপে আমরা একজন আরেকজনের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম। জিপ থেকে নেমে রিসাং ঝর্ণা পর্যন্ত রাস্তাটা ছিল খুবই কর্দমাক্ত। বর্ষার শেষ হওয়াতে ঝর্ণার পানি কম ছিল, অপরিচিত ভাই-ব্রাদারদের সাথে ছবি তুলছিলাম, একজন আরেকজনের ছবি তুলে দিছিলাম। একটি সুন্দর সম্পর্ক এখান থেকেই শুরু হয়েছিল।
রিসাং ঝর্ণা ঘুরে আমাদের এবারের গন্তব্য আর্মি ক্যাম্পের পথে। আর্মি ক্যাম্পে সাজেক যাওয়া জিপ গাড়ির বিশাল লাইন। সেখানে আর্মিদের সকল ফর্মালিটিস শেষ করে জীপ গাড়িগুলি আকাবাকা পথ বেয়ে সাজেকের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল।
আর্মি ক্যাম্প থেকে সাজেক যাওয়ার রাস্তাটা দারুন আনন্দদায়ক এবং অ্যাডভেঞ্চারাস ছিল। কখনো ঢালু বা কখনো খাড়া রাস্তা বেয়ে আমরা সাজেকে যাচ্ছিলাম। “আহ!!! কি সুন্দর প্রকৃতি, মরি মরি সুন্দরি, তোমার রুপের ঝলকে”।